ভীর রাত, ১২:০০ টা কি ১:০০ টা বাজে। গ্ৰামের আশপাশের লোকজন সকলেই ঘুমুচ্ছে। গ্ৰামের এক কোনে, সভাপতির বাড়িতে জ্বলছে বাতি, বাড়ির সবাই জেগে আছেন। আশপাশের গ্ৰামের অনেকেই এসেছেন দেখতে। সামনে অ্যাম্বুলেন্স পেছনে মাইক্রোবাস। ‌যেখানে আছি আমি, আম্মু, নানু, ভাই, আম্মুর ফুফাতো ভাই ও অন্য আরেকজন। অ্যাম্বুলেন্সে আমার ছোট মামা ও নানাভাই। মামা সামনে বসা, নানাভাই পেছনে শুয়া, এসির মধ্যে সাদা কাপড় দিয়ে সম্পূর্ণ ঢাকা। চিকিৎসকের গাফিলতিতে হয়তো আজ এক বাস্তব বেদনাদায়ক গল্প লিখছি। 


সময়টা ১১/১১/২০২১ সকালে আমার নানা ঘুম হতে জেগে কিছুক্ষণ পর আমার সাথে বকাবকি করলেন। আসলে আমার তাঁর সাথে কম কথা হয়েছিল, তাই। সকালে, খুব সম্ভবত খালি পেটে তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বলা হয়েছিল। মামা আর নানু নাস্তা সেরে রেডি হলেন যাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে প্রত্যেক বারের মতো আমাকে, ভাইয়াকে ও আম্মুকে এক-এক-এক করে তিন হাজার দিয়ে গেলেন। আমি ও ভাইয়া নানাকে একটু সামনে এগিয়ে দিয়ে এলাম। যাওয়ার সময় নানাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "নানাভাইয়া আপনি কী আবার আসবেন‌?" বলেছিলেন, "দেখি। যদি ডাক্তার সবকিছু ঠিক বলে তাহলে ওখান দিয়ে যাব গা। আর যদি রিপোর্ট ঠিক না থাকে তাহলে আবার আসবো।" সিএনজি তে উঠার আগে নানাভাইকে সালাম করলাম। কেমন জানি ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে একটু জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু লজ্জার কারণে তা আর করা হলো না। ওনারা রওনা দিলেন হাসপাতালের দিকে, আমি ঘরে চলে আসলাম। 


দুপুর ১:০০ টা না ২:০০ টার নাগাদ আম্মু জোরেসরে রান্না করে দৌড় দিলেন হাসপাতালের দিকে। যাওয়ার আগে আম্মু বলছিল যে তার ভালো লাগছে না কেমন জানি লাগছে ভেতরে ভেতরে। আম্মু গেল হাসপাতালে আর আমি ঘরে ছিলাম। আমার মধ্যেও কেমন জানি লাগছিল। সন্ধ্যা ৬:০০ ঘরে আমি একলা। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। ভাইয়া ফোনে বলল, " তাসিব, ব্যাগ গুছা। কাপড় সব নেয়।" পরক্ষণে বুঝলাম কী হয়েছে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, "কেন?" উত্তরে,"নানাভাই আর নাই।" 


সবশেষে ভাইয়া আসে, সিএনজি করে বাসা থেকে যাই ইউনাইটেডে। নানু কাঁদছে। মামাও মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছিলেন। আত্মীয়রাও আসেন। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা ইউনিয়নে। ঢাকা থেকে একটা মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রওনা দিই গন্তব্যের দিকে, পৃথিবীতে আমার নানাভাইয়ের শেষ ঠিকানায়।


সারাটা পথ কান্নাকাটির আওয়াজ। হাইওয়ে হতে গ্ৰামের পথে ঢুকলাম। সামনে অ্যাম্বুলেন্স‌, পেছনে আমরা। বাড়ির কাছে আসতেই একটা সাইরেন বাজিয়ে জানান দেওয়া হলো। উঠানে সারি সারি চেয়ার। লাইট জ্বলছে আঙ্গিনায়। সবাই অপেক্ষামান। সাথে সাথে শুরু হল বুক ফাটা কান্নার জোয়ার।


সবকিছু ভুলে গেলেও আম্মুর হয়তো একটা কথা মনে থাকবে, "আমার মেয়ে সেরা রাঁধুনি।" আর আমার মনে থাকবে,"কী মিয়া বুক ফুলাই চলবা... ... ...দেখি না আবার আসবো।" 


সেদিন উপলব্ধি করলাম যে একটা সাইরেনের পেছনে থাকে অনেকের দুঃখ, কান্না, স্বজন হারানোর বেদনা! 


পৃথিবীতে দুটো জিনিস স্থির, যা হবেই হবে। এক হলো জন্ম, আরেক হলো মৃত্যু!